শিক্ষার গুণগত পরিবর্তনে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম
গুণগত মান নিশ্চিতকরনে শিক্ষায় তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য। বিশ্বায়নের যুগে উন্নত দেশের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্য-প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়েছে। শিক্ষার প্রচলিত ধারার শিখন-শেখানো পদ্ধতির পরিবর্তে শিখন-শেখানো পদ্ধতিতে তথ্য-প্রযুক্তির সংযোগ ঘটানো হয়েছে। শ্রেণি কার্যক্রমে অন্যান্য শিক্ষা উপকরণের মতো প্রযুক্তিকেও একটি শিক্ষা উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়েছে, যা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন মেটাতে সহায়তা করছে। কম্পিউটার শিক্ষা বা ল্যাবভিত্তিক বদ্ধমূল ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে তথ্য-প্রযুক্তিকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমে কাজে লাগানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে কম্পিউটার বা অন্যান্য তথ্য-প্রযুক্তি ব্ল্যাকবোর্ডের পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষে ব্যবহূত একটি আধুনিক শিক্ষা উপকরণ হিসেবে কাজ করছে। এ লক্ষ্যে সরকারের তরফ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ব্যবহূত বিভিন্ন উপকরণের পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট মডেম ও স্পীকারের সমন্বয় ঘটানো হয়েছে। এ শ্রেণিকক্ষকেই বলা হচ্ছে ‘মাল্টিমিডিয়া ক্লাশরুম’।
‘তথ্য-প্রযুক্তি শিক্ষা নয়, শিক্ষায় তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার’-এই শ্লোগানকে সামনে রেখে ২০১২ সালের ২০ মে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের সকল মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও শিক্ষক কর্তৃক ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। উদ্দেশ্য ছিল, যেন কঠিন, দূর্বোধ্য ও বিমূর্ত বিষয়সমূহকে শিক্ষকগণ ছবি, অ্যানিমেশন ও ভিডিও ক্লিপের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সামনে সহজবোধ্য করে উপস্থাপন করার মাধ্যমে শ্রেণি কার্যক্রমকে আনন্দময় করে তুলতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, হূদপিন্ড, পাকস্থলী ও ফুসফুসের কার্যপ্রণালী; উদ্ভিদের বৃদ্ধি, শ্বসন ও অঙ্কুরোদগম; প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য ও প্রাকৃতিক দূর্যোগের নানা কার্যকারণ সম্পর্ক শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর ক্ষেত্রে ছবি, অ্যানিমেশন বা ভিডিও’র কোন বিকল্প নেই। গণিতের প্রতিটি বিষয়ের তাত্ত্বিক ধারণা শিক্ষার্থীদের কাছে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের মাধ্যমে মূর্ত করা সম্ভব। এভাবে ইংরেজী, বাংলা, সমাজ, ধর্মসহ প্রতিটি বিষয়ে শিক্ষার্থীদেরকে সুস্পষ্ট ও বৈশ্বিক ধারণা মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের মাধ্যমে দেওয়া যেতে পারে।
মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম সম্পর্কে অনেক শিক্ষকদের মধ্যে কিছু ভুল ধারনা রয়েছে। তারা মনে করেন:
১. মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম মানে কম্পিউটার শিক্ষা;
২. মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম মানে শিক্ষার্থীদের কম্পিউটারের উপর লেকচার দিতে হবে;
৩. মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম মানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করতে হবে;
৪. মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম মানে শিক্ষকদের ক্ষমতায়িত না করে প্রযুক্তিকে মূল ফোকাস করতে হবে;
৫. মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম মানে সকল শিক্ষককে ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করতে হবে।
এ ভুল ধারনা থেকে প্রত্যেক শিক্ষককে বের হয়ে আসতে হবে এবং মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ব্যবহারের মাধ্যমে গতানুগতিক শিক্ষক-কেন্দ্রিক শিক্ষা কার্যক্রমকে শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক আনন্দময় শিক্ষায় রূপান্তর করতে হবে। অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে শিক্ষকগণ নিজেদের তৈরিকৃত ডিজিটাল কনটেন্ট ব্যবহার করে অত্যন্ত আনন্দদায়ক ও কার্যকরভাবে শ্রেণিপাঠ পরিচালনা করছেন এবং শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে অংশগ্রহণমূলক পরিবেশে শিখতে পারছে। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের মাধ্যমে পাঠকে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করা, কঠিন বিষয় সহজভাবে তুলে ধরা, শিক্ষার্থীদের সহজে শিখন কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা এবং সৃজনশীল প্রশ্নের অনুশীলন কার্যক্রম খুব সহজভাবেই পরিচালনা করা যায়।
২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রামের উদ্যোগে ৭টি বিদ্যালয়ের ২৩ জন শিক্ষক নিয়ে পাইলট আকারে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম কার্যক্রম শুরু করা হয়েছিল। এ পাইলট কর্মসূচির সফল অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে, এটুআই প্রোগ্রামের সহযোগিতায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সারাদেশে পঁচিশ হাজারের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করেছে। এর মধ্যে ২০,৫০০ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘শিক্ষায় তথ্য-প্রযুক্তি’ প্রকল্পের মাধ্যমে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হয়েছে।
এটুআই প্রোগ্রামের সহযোগিতায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় উদ্যোগে ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৫৫ হাজারের বেশি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষককে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। শিক্ষকগণ বিজ্ঞান, গণিত, ভূগোল, ধর্ম, বাংলা, কৃষিশিক্ষাসহ প্রতিটি বিষয়ের ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করছেন ও মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে ব্যবহার করছেন। বাংলাদেশের সকল শিক্ষকদের একটি কমন প্ল্যাটফরমে নিয়ে আসার জন্য ব্রিটিশ কাউন্সিলের সহযোগিতায় এটুআই প্রোগ্রাম শিক্ষক বাতায়ন (teachers.gov.bd) তৈরি করেছে। শিক্ষকগণ তাদের তৈরিকৃত ডিজিটাল কনটেন্ট, ভিডিও, এনিমেশন এখানে শেয়ার করেন এবং অন্যান্য শিক্ষকগণ তা প্রয়োজনে ডাউনলোড করে নেন। শিক্ষক বাতায়নে মোট ৪৫,০০০ জন শিক্ষক রয়েছেন, যারা নিয়মিত ডিজিটাল কনটেন্ট আপলোড করছেন ও ডাউনলোড করছেন। এখানে ২৫ হাজারের বেশি ব্লগপোস্ট ও ১২ হাজারের বেশি ডিজিটাল কনটেন্ট রয়েছে। শিক্ষক বাতায়নের সদস্য সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। গ্রাম-শহরের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যকার বৈষম্য দূর করছে শিক্ষক বাতায়ন। ঢাকার ভিকারুননূন নিসা স্কুলের ডিজিটাল কনটেন্ট যেন সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থী বা সুনামগঞ্জের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কনটেন্ট যেন খুলনার প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষক বা শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করতে পারেন, তার জন্যই সরকারের এই প্রয়াস।
মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম মনিটরিং ও মেইনটেনিং-এ জেলা-উপজেলা প্রশাসন, জেলা-উপজেলা শিক্ষা অফিস ও টিচার্স ট্রেনিং কলেজ সমন্বিতভাবে কাজ করছে। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম (এমএমসি) অনলাইনে ম্যানেজমেন্ট ও মনিটরিং করার জন্য এটুআই প্রোগ্রাম থেকে একটি অনলাইন ড্যাশবোর্ড (mmm.e-service.gov.bd) তৈরি করা হয়েছে। দেশের সকল মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা বর্তমানে এ ড্যাশবোর্ডের মাধ্যমে মনিটরিং করা হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে প্রাথমিক ও কারিগরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমও এ ড্যাশবোর্ডের মাধ্যমে মনিটরিং করা শুরু হবে। জেলা পর্যায়ে যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সফলভাবে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম পরিচালনা করছে, এবারের ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলায় এরকম অগ্রণী ৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কৃত করা হচ্ছে।
২০১৩ সালে পার্টিসিপাটরি ম্যানেজমেন্ট ইনিশিয়েটিভ ফর ডেভেলপমেন্ট (পিএমআইডি)-এর মাধ্যমে ১৫৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের একটি ইমপ্যাক্ট স্টাডি করা হয়েছিল। গবেষনার ফলাফলে দেখা যায় যে, যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের মাধ্যমে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়, সেখানে শিক্ষার্থীরা ক্লাস লেসন ভালভাবে বুঝতে পারে এবং তাদের মুখস্থ বিদ্যার প্রবণতা কমেছে। এ সকল শিক্ষার্থীদের শেখার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে এবং ক্লাসে তাদের একঘেয়েমিভাবও দূর হয়েছে। এ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকগণের সাক্ষাতকার গ্রহণ করে জানা যায় যে, ইন্টারনেট সার্চ করে বিভিন্ন দেশের শিখন-শেখানো উপকরন ডাউনলোড করে নিজ সংস্কৃতি, বিষয় ও শ্রেণি উপযোগী কনটেন্ট তৈরি করার মাধ্যমে শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা ও জ্ঞান বৃদ্ধি পেয়েছে। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে তাদের আত্মবিশ্বাস বহুগুণে বেড়েছে। তারা শিক্ষার্থীদের সাথে খুব সাবলীলভাবে যোগাযোগ স্থাপন ও অতি সহজেই ক্লাস পরিচালনা করতে পারছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানগণের মতামত বিশ্লেষন করে দেখা যায় যে, এসব প্রতিষ্ঠানের ফলাফল পূর্বের থেকে ভাল হয়েছে, প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের মাত্রা বেড়েছে এবং শিক্ষার গুণগত পরিবর্তন ঘটছে।
আমাদের শিক্ষার্থীদের একুশ শতকের দক্ষ জনগোষ্ঠী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। আর এ কাজ সম্পাদনে শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্য-প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটানোর কোন বিকল্প নেই। এ বিবেচনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম একটি যুগোপযোগী এবং সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস